মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ১০:২১ অপরাহ্ন
বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া ইউনিয়নটি এমনিতেই করালগ্রাসী মেঘনা নদীর ভাঙন কবলিত। তার ওপর ইউনিয়নটিকে আবার দুই ভাগে বিভক্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রনায় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করায় জনসাধারণের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিভক্তির ক্ষেত্রে সব ধরনের নীতিমালা উপেক্ষা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা।
তারা বলছেন, নির্বাচিত চেয়ারম্যানের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দায়িত্ব নিয়ে ইউনিয়ন বিভক্তির আবেদন করে আইনি জটিলতা সৃষ্টি করেন। কারণ তিনি চাচ্ছেন যে করে হোক চেয়ারম্যান পদে থাকতে হবে। যদিও আবেদনকারী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি অস্বীকার করে বলছেন- সকল নীতিমালা মেনেই ইউনিয়ন বিভক্তির আবেদন ও প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
স্থানীয় বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ জনগনের সাথে কথা বলে জানা যায়, বরিশালের উল্লেখযোগ্য ইউনিয়নগুলোর মধ্যে উলানিয়া ইউনিয়ন অন্যতম। কয়েক যুগ ধরে মেঘনা নদীতে মেহেন্দিগঞ্জ অঞ্চলটি ভাঙনের শিকার। ইতিপূর্বে পাশ্ববর্তী গোবিন্দপুর ইউনিয়নটি সম্পূর্ণভাবে নদী গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। গত ৪/৫ বছর যাবত মেঘনার ভাঙনের মুখে পড়ে বেশ কয়েকটি গ্রামের সিংহভাগ বিলিন হয়েছে।
এদিকে, নদী ভাঙনের শিকার সাধারণ মানুষ যখন বসতি স্থাপনে হিমশিম খাচ্ছে ঠিক সেই মুহুর্তে চলতি বছরের ২১ আগষ্ট ইউনিয়নটিকে দুই ভাগে বিভক্তি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়। অথচ স্থানীয় সরকার বিভাগের (ইউনিয়ন পরিষদ) নীতিমালায় রয়েছে- নতুন যেকোন ইউনিয়ন স্থাপনে তার আয়তন কমপক্ষে ২০ বর্গ কিলোমিটার হতে হবে। কিন্তু উলানিয়া ইউনিয়নের মোট ২৪ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ৭ বর্গ কিলোমিটার ইতোমধ্যে মেঘনার তলদেশে হারিয়ে গেছে।
বর্তমানে স্থলভাগে থাকা ইউনিয়নের ১৭ দশমিক শুন্য ৪ বর্গ কিলোমিটারের তথ্য গোপন করে নদীর তলদেশের তথ্য সামনে এনে ২৪ দশমিক ৬৮ বর্গ কিলোমিটারকে দুই ভাগে বিভক্ত করে উলানিয়া উত্তর ও দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদ করা হয়েছে।
বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার শাখা থেকে মন্ত্রনালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের মধ্যে ৯টি উত্তর উলানিয়া ও ৪টি গ্রাম দিয়ে দক্ষিণ উলানিয়া করার প্রস্তাবনা করা হয়েছে।
১২ দশমিক শুন্য ২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের যে ৪টি গ্রাম নিয়ে নব গঠিত দক্ষিণ উলানিয়া করা হয়েছে তার মধ্যে তিনটি গ্রামের পঞ্চাশ শতাংশ মেঘনায় বিলিন। অন্যদিকে ১২ দশমিক ৬৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের যে ৯টি গ্রাম নিয়ে নবগঠিত উত্তর উলানিয়া ইউনিয়ন করা হয়েছে তার মধ্যে তিনটি গ্রামের অধিকাংশ মেঘনায় বিলিন হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানায়, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন সরদার গত ২০১৭ সালের ২৯ আগষ্ট মৃত্যুবরন করেন। তার মৃত্যুতে পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান লিটন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি পরের বছর (২০১৮) বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার শাখায় একটি আবেদন করেন। ওই আবেদনে উল্লেখ করেন- উলানিয়া ইউনিয়নের নাগরিক তুলনামূলক অনেক বেশী। যার নাগরিক সেবা উলানিয়া ইউনিয়ন পরিষদ দিতে ব্যর্থ। তাই ইউনিয়নটি দুইভাগে বিভক্ত করা প্রয়োজন। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে সঠিক সরেজমিন তথ্য সরবরাহ না করার অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধীক স্থানীয় সাবেক ও বর্তমান মেম্বার এবং চেয়ারম্যান প্রশ্ন রেখে বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী এই ইউনিয়নটিতে নির্বাচিত চেয়ারম্যান-মেম্বাররা নাগরিক সেবা দিয়েছে। আর বর্তমানে নদী ভাঙনে ছোট হয়ে আসা ইউনিয়নবাসীর সেবা দিতে পারছেন না কোন যুক্তিতে ? প্রকৃত পক্ষে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাঁধাগ্রস্ত করে পদে থাকার জন্যই মূলত এই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন।
বর্তমান ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড সদস্য আরিফুর রহমান সবুজ বলেন, আমার ওয়ার্ডের সত্তর ভাগ এলাকা মেঘনা নদীতে বিলিন হয়ে গেছে।
একই কথা বলেন ৩ নং ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল মতিন। তিনি বলেন, আমার ওয়ার্ডের পঞ্চাশ ভাগ এলাকা নদীতে হারিয়ে গেছে।
২ নং ওয়ার্ড সদস্য ইয়াসিন রাজু বলেন, আমার ওয়ার্ডের বেশকিছু এলাকা নদীতে ভেঙ্গে গেছে।
উলানিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. জামাল হোসেন মোল্লা বলেন, আমি চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় ২০১১ সালে ইউনিয়নের স্থল ভাগের আয়তন ছিলো ১৭.০৫ বর্গ কিলোমিটার। গত ৮ বছরে মেঘনা নদীতে আরও ২/৩ বর্গ কিলোমিটার বিলিন হয়েছে। প্রতিনিয়ত নদী ভাঙনের শিকার ইউনিয়নটি বিভক্ত করার কোন যুক্তি আমি দেখছি না।
উলানিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান লিটন বলেন, জনগনের ভোগান্তি লাগবে ইউনিয়ন পরিষদকে বিভক্ত করার আবেদন করেছি। নির্বাচন বন্ধে জটিলতা সৃষ্টি করা আমার লক্ষ্য নয়।
মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা (অতিরিক্ত) হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, স্থানীয়দের আবেদনের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশে উলানিয়া ইউনিয়নটি বিভক্ত করা হয়েছে। আমার জানা মতে তথ্য প্রস্তাবনায় কোন অনিয়ম হয়নি।
বরিশাল জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম বলেন, উলানিয়া ইউনিয়নকে বিভক্ত করে স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ফলে দুটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড পূর্নবিন্যাস ও ভোটার তালিকা হালনাগাদ সহ যাবতীয় কাজ সম্পন্নের পর নির্বাচন অনুষ্ঠানে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
বরিশাল জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়ার রহমান বলেন, নীতিমালা অনুসরন করেই ইউনিয়ন পরিষদ বিভক্তি করা হয়েছে।