রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:১৫ পূর্বাহ্ন
মুয়াজ্জিনের মোবাইল ফোনসেট চুরি করায় মাদরাসার অধ্যক্ষ আগের রাতে একজন শিক্ষককে থাপ্পড় দিয়েছিলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছিলেন ওই শিক্ষক। হুমকি দেওয়ার ১২ ঘণ্টা না পেরোতেই এলাকাবাসী ওই শিক্ষকের ঘরের ওয়ার্ডরোব থেকে অধ্যক্ষের একমাত্র শিশুপুত্রের লাশ উদ্ধার করেছে।
গত বুধবার রাতে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা ঘটেছে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের মরাশ গ্রামের ‘মরাশ বাগে জান্নাত আরাবিয়া হাফিজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানা’য়।
নিহত শিশুটির নাম আহনাফ হোসেন আদিল (৪)। সে ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ (বড় হুজুর) ময়মনসিংহের নান্দাইল পৌর এলাকার দশালিয়া গ্রামের হাফেজ মুফতি জুবায়ের আহমেদ শাহিনের ছেলে। জুবায়ের ওই মাদরাসার মসজিদের ইমামও। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিনি মাদরাসা ভবনের দোতলার একটি ঘরে থাকতেন।
এলাকাবাসী বুধবার রাতেই আদিল হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে হুমকিদাতা ওই শিক্ষক হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার তেঘরিয়া গ্রামের মৃত নোয়াব আলীর ছেলে হাফেজ মো. জুনায়েদ আহমেদ (৩০) ও মসজিদের মুয়াজ্জিন একই এলাকার জফু মিয়ার ছেলে মো. খাইরুল ইসলামকে (২২) আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে।
অধ্যক্ষ জুবায়ের আহমেদ বাদী হয়ে ওই দুজনকে আসামি করে কালীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলায় জুনায়েদ ও খাইরুলকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে আদালতে পাঠায় পুলিশ। বিচারক তাঁদের জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
অধ্যক্ষ জুবায়ের সাংবাদিকদের বলেন, গত মঙ্গলবার মসজিদের মুয়াজ্জিন খাইরুল ইসলামের ১৪ হাজার টাকা দামের একটি মোবাইল ফোনসেট হারিয়ে যায়। মুয়াজ্জিন মাদরাসা শিক্ষক জুনায়েদ আহমেদকে সন্দেহ করে তাঁর কাছে নালিশ করেন। বুধবার ভোরে মোবাইল ফোনসেটটি হাফেজ জুনায়েদের ঘর থেকে উদ্ধার হয়। এরপর ফজরের নামাজের আগে তিনি জুনায়েদকে ডেকে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপকর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য সতর্ক করে দেন এবং একটি থাপ্পড় মারেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জুনায়েদ তাঁর ক্ষতি করবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন।
জুবায়ের বলেন, সেই ক্ষতি যে তাঁর একমাত্র ছেলের জীবন কেড়ে নেওয়া হবে, তা কল্পনাও করতে পারেননি তিনি। তাঁর সন্তানকে গলা টিপে হত্যা করে নিজের ঘরে ওয়ার্ডরোবে লাশ রেখে কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন জুনায়েদ। এরপর তিনি জামায়াতে আসরের নামাজ পড়েছেন। নামাজ শেষে দীর্ঘ সময় কোরআন তেলাওয়াত করেছেন। আসরের পর যখন ছেলেকে খুঁজে না পেয়ে তিনি ও অন্যরা আশপাশে খোঁজাখুঁজি করছিলেন, তখন জুনায়েদ মসজিদের মাইকে আদিলের সন্ধান চেয়ে মাইকিংও করেন।
জুবায়ের অভিযোগ করেন, মুয়াজ্জিন খাইরুলের সহায়তায় জুনায়েদ তাঁর ছেলেকে হত্যা করেছেন। তিনি দুজনের ফাঁসি দাবি করেন।
মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সদস্য সিরাজুল হক বলেন, দোতলা মাদরাসা ভবনে ৫৮টি ছেলে-মেয়ে পড়ালেখা করে। মাদরাসা ভবনের সামনে মসজিদ। মসজিদের ডান দিকে টিনের ঘরে ছোট হুজুর জুনায়েদ এবং বাঁ দিকের দোতলায় থাকেন বড় হুজুর জুবায়ের। অধ্যক্ষ জুবায়ের মাদরাসায় পাঁচ বছর ধরে আছেন। আর শিক্ষক জুনায়েদ ও মুয়াজ্জিন খাইরুল আছেন সাত-আট মাস ধরে। জুনায়েদের স্ত্রী ১৫-১৬ দিন আগে গ্রামের বাড়িতে যান। বুধবার বিকেল ৩টার দিকে মাদরাসার উঠানে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় অধ্যক্ষের ছেলে আদিল। গ্রামের লোকজন মাদরাসার পুকুরসহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি শুরু করে। তখন জুনায়েদ ও খাইরুলের আচরণ ও ভূমিকা রহস্যজনক মনে হয়। গ্রামের লোকজন দুজনকে সন্দেহ করে জিজ্ঞাসাবাদ করে মোবাইল ফোনসেট চুরি ও থাপ্পড় মারায় হুমকি দেওয়ার বিষয়টি জানার পর তাঁদের আটক করে। পরে জুনায়েদের ঘর তল্লাশি করে ওয়ার্ডরোবে রাখা কাপড়ের নিচে পাওয়া যায় আদিলের নিথর দেহ। রাত ৯টার দিকে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।
গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে কথা হয় মাদরাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষার্থী শাহাদাত্ হোসেন (১৩) ও নেজারত বিভাগের শিক্ষার্থী ইফতেখার হোসেনের (১২) সঙ্গে। তারা জানায়, তারা আদিলের সঙ্গে খেলছিল। একপর্যায়ে ফুলগাছের পাতা ছেঁড়ায় আদিলকে তাঁর ঘরে ডেকে নিয়ে যান শিক্ষক জুনায়েদ। কিছুক্ষণ পর হঠাত্ মুয়াজ্জিন তাদের ডেকে নিয়ে উচ্চস্বরে কোরআন পড়তে বলেন। উচ্চস্বরে না পড়লে পিটুনিও দেন। পরে তারা শুনেছে যে গলা টিপে হত্যার সময় আদিলের কান্নার আওয়াজ যাতে শোনা না যায় সে জন্য মুয়াজ্জিন তাদের উচ্চস্বরে কোরআন পড়তে বলেছিলেন।
কালীগঞ্জ-কাপাসিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পঙ্কজ দত্ত জানান, শিশুটিকে শ্বাসরোধে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে। থাপ্পড় ও বকাঝকার প্রতিশোধ নিতেই অধ্যক্ষের ছেলেকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন জুনায়েদ। হত্যাকাণ্ডে মুয়াজ্জিনের জড়িত থাকার বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।