শনিবার, ২৭ Jul ২০২৪, ০৬:৩৯ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ সংবাদ :
কাউখালীতে অবৈধভাবে দখলকৃত সরকারি জায়গা উদ্ধার করল উপজেলা প্রশাসন কাউখালীতে নাশকতায় মামলায় জামায়েত সেক্রেটারিসহ ৪জন গ্রেফতার কটুক্তির প্রতিবাদে পিরোজপুরে মুক্তিযোদ্ধা ও সন্তানদের মানববন্ধন কাউখালী গাঁজা সহ এক ঔষধ ব্যবসায়ী গ্রেফতার মারা গেছেন ছারছীনার পীর কাউখালীতে বিআরডিবি অফিসের জনবল সংকট, কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভুক্তভোগী জনগণ কাউখালীতে ৪০ পিস ইয়াবাসহ দুই মাদক ব্যবসায়ী আটক কাউখালীতে কৃষকদের মাঝে ফলের চারা বিতরণ বালু বোঝাই বাল্ক‌হেডের ধাক্কায় ব্রিজ ভে‌ঙে খা‌লে এক বছরেও পুণ:নির্মাণ হয়নি নাজিরপুরে যে কারনে মাকে কুপিয়ে হত্যা করলো ছেলে ৯ বছরের সাজার জন্য ৩৫ বছর পালিয়েও শেষ রক্ষা হলো না স্কুল ছাত্রী অপহরণের ৩৩ দিন হলেও এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি কাউখালীতে ৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলাম শিক্ষার ক্লাস নিচ্ছেন হিন্দু শিক্ষক পিরোজপুরে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উপলক্ষে বিশেষ সেবা কার্যক্রম উদ্বোধন কাউখালী সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে দেখা গেল সাপ কাউখালী উপজেলা অস্থায়ী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই চিকিৎসক নেই বেড, রোগীদের দুর্ভোগ চরমে কাউখালীতে ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে হাইজিন কিট বিতরন পিরোজপুরে দুঃস্থ ও অসহায় পরিবারের মাঝে ঢেউটিন ও নগদ অথের্র চেক বিতরণ কাউখালীতে জমি জমা নিয়ে সংঘর্ষে আহত ৪, গ্রেপ্তার ৪ নেছারাবাদে রিমালে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ব্র্যাকের মানবিক সহায়তা প্রদান
কত দূর পর্যন্ত আধুনিক হলাম?

কত দূর পর্যন্ত আধুনিক হলাম?

জয়া ফারহানা

ধর্ষকের কোনো জাত, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা শ্রেণি নেই, তার একমাত্র পরিচয় সে ধর্ষক, এমন আপ্তবাক্য প্রায়ই শোনা যায়। কখনো কি চিন্তা করে দেখেছি এই কথাটি বলে আমাদের পাশে থাকা ধর্ষকের পরিচয়টি আমরা আড়াল করে রাখছি? ধর্ষকের জাত, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি সবই আছে। ধর্ষককে পশুর সঙ্গে তুলনা করারও দরকার নেই। সে মানুষই, তবে বিপর্যস্ত ব্যক্তিত্বের। কখনো তা-ও নয়। যৌন নির্যাতন, হেনস্তা, হয়রানির মধ্যে সব সময় যৌনতা থাকেও না। কখনো এটি ব্যাধি, যেখানে মানসিক বা শারীরিক তৃপ্তির চেয়ে নিজের পৌরুষ প্রতিষ্ঠাই থাকে প্রধান কারণ। কখনো থাকে শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার সত্তা, কখনো আধিপত্যবাদী সত্তা, কখনো অত্যাচারী মানসিকতা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনীতিও। বড়জোর প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন বিশেষ কোনো পারিবারিক পরিবেশ আছে কি না, যেখান থেকে উঠে আসা ব্যক্তিরা পারসোনালিটি ডিস-অর্ডার বা বিপর্যস্ত ব্যক্তিত্বের সমস্যায় ভোগে। প্রশ্ন উঠতে পারে, অসুখী দম্পতির সন্তানের মনে বিকৃত, অসামাজিক মনের প্ররোচনা বা ধর্ষণের আগ্রহ কাজ করে কি না। প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রবলেম চাইল্ডরাই এজাতীয় ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে কি না।

অপরাধবিজ্ঞানে আগ্রহী পাঠকরা জানেন কারো কারো জিনের মধ্যেই থাকে বিকৃতি। আবার অনেকের ক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকেই একটা অত্যাচারী বিকৃত প্ররোচনাকারী মানসিকতা কাজ করে। অপরাধবিজ্ঞান বলছে, এদের ওপর চিকিৎসাও ফলপ্রসূ হয় না। কারো কারো ক্ষেত্রে কাউন্সেলিংয়ে সুফল মেলে। কোনো কোনো পরিবার আছে, যেখানে পুত্রসন্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আনন্দ নিয়ে যতখানি ভাবা হয়, কন্যাসন্তান নিয়ে ততটা নয়। কন্যাসন্তানকে কোনো রকম বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়াটাই এসব পরিবারের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি পুত্রসন্তানের মনে ছোটবেলা থেকেই যেকোনো কিছু অবৈধভাবে ভোগ করার ইচ্ছা জাগিয়ে তোলে। ছেলেদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা নিজের পাওনা খাবারের অংশটুকু খাওয়ার পর অন্যের দিকে হাত বাড়িয়েছে। এরা নিজের খেলনা অন্যকে দেবে না; কিন্তু অন্যেরটা নেবে। অনেক অভিভাবক আছেন, যাঁরা পুত্রসন্তানের এই অন্যায্য, অনৈতিক ভোগের বাসনাকে তিরস্কার করেন না। ব্যক্তিত্বের এসব সমস্যা সারিয়ে তোলার পরিবর্তে এসব ত্রুটিবিচ্যুতিকে উদাসীনতার চোখে দেখা হয়। ‘ও ছোট মানুষ, অবুঝ, বোঝে না, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে’ জাতীয় শিথিলতা দেখিয়ে উপেক্ষা করে যান। অপরাধবিজ্ঞান বলছে, বড় হয়ে এসব ছেলের হাতেই এক্সপ্লয়েড হয় মেয়েরা। শুধু যে এসব ছেলের হাতেই মেয়েরা যৌন হেনস্তার শিকার হচ্ছে, তা নয়। প্রত্যন্ত গ্রামে অল্পবয়সী ছেলেদের হাতে হাতে পৌঁছে গেছে মোবাইল ফোন। কোনো রকম সেন্সরশিপ ছাড়াই তারা দেখছে পর্নোগ্রাফি। ফল হয়েছে এই—ভিড়ের বাসে, রাস্তাঘাটে, বাজারে ফ্লাইং পারভার্টসের সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে।

কেউ বলতে পারেন, কই সেই ১৭ থেকে ৭০ অবধি এই শহরে তো একা একা ঘুরছি, আমার তো কখনো কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা হয়নি। তবে আপনি সেই মুষ্টিমেয় ভাগ্যবানদের একজন। যিনি সমস্যায় পড়েন, সমস্যা মোকাবেলায় তিনি যে সব ক্ষেত্রে, সব সময় আইনের সহযোগিতা পান, তা নয়। আবার সাহায্য নিলেও যে সমস্যা মেটে, তা-ও নয়। যিনি সমস্যা তৈরি করছেন, তিনি কতটা প্রভাবশালী, কতটা ক্ষমতাধর, তা বিবেচনায় রাখতে হয়, এটাই বাস্তবতা। পারিপার্শ্বিকতাকে হিসাবে রাখতেই হয়। যৌন হয়রানির প্রতিটি ঘটনা নুসরাত হত্যার মতো মনোযোগ পায় না। যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন, ওই একই দিনে একজন গার্মেন্টকর্মীও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। গার্মেন্টকর্মীটি কী রকম ট্রমার মধ্যে আছেন সে খবর কিন্তু আমরা রাখছি না। যে ধর্ষণ করে তার প্রভাব যেমন মাথায় রাখা হয়, তেমনি ধর্ষণের শিকার কে হচ্ছে, সেটিও বোধ হয় সমাজ মাথায় রাখে। প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে একজন গৃহবধূ ধর্ষণের শিকার হলে সমাজের তেমন কিছু আসে যায় বলে মনে হয় না। তেমন কোনো আলোড়ন-বিলোড়নও লক্ষ করি না। ধর্ষণের শিকার নারীদের সঙ্গে বৈষম্য দেখে এই সমাজকে কিছুটা হলেও চেনা যায়।

দুই.

একসময় ভাবা হতো মেয়েরা আর্থিক সংগতি অর্জন করলে ধর্ষণের ঘটনা কমে আসবে বা থাকবে না। এখন দেখা যাচ্ছে আর্থিক সামর্থ্য যত বাড়ছে, মেয়েদের কাজের পরিধি যত বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনাও তত বেড়ে যাচ্ছে। গৃহবন্দি হয়ে থাকাই কি তবে সমাধান? না, তা-ও নয়। ছেলেরা ভাবে, তারা মেয়েদের চেয়ে উত্কৃষ্ট জীব। নিকৃষ্ট জীবের ওপর আধিপত্য বিস্তারের ক্ষুধাই এদের প্ররোচিত করে। নারী ও পুরুষের মধ্যে যে অদ্ভুত প্রভেদরেখা পুরুষরা তাদের অজান্তে তৈরি করেছে, পুরুষরা যে নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবছে—যতক্ষণ তা দূর না হচ্ছে ততক্ষণ সমাজ থেকে ধর্ষণ নির্মূল হবে না। আইন, শাস্তির ভয়, সচেতনতা এবং মূল্যবোধ উন্নয়নের মাধ্যমে পুরুষের মনের অন্ধকার কিছুটা দূর করা যাবে হয়তো।

মুশকিল হলো সমাজ ও রাজনীতি অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত। সমাজ যত দূর এগোয় রাজনীতিও তত দূর এগোতে পারে। সমাজ এগোয়নি বলেই মেয়েদের বিয়ের বয়সের আইনে এখনো একটি শর্ত জুড়ে দেওয়া আছে। সমাজকে অখুশি রেখে রাজনীতি চলে না, চলবেও না। অল্পবয়সী মেয়ে বিয়ের ধ্রুপদি আকাঙ্ক্ষাকে রাজনীতি সম্মান জানিয়েছে। প্রায়ই আমরা দাবি করি, আমরা অনেক আধুনিক হয়েছি। আসুন, একটু খতিয়ে দেখি কত দূর আধুনিক হয়েছি। কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যায় এখনো বিশ্বে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত প্রথম। বাংলাদেশও মোটেই পিছিয়ে নেই। এখনো জাত-ধর্মের বাইরে জীবনসঙ্গী নির্বাচন করলে আপনার জাতের লোকের হাতেই মারা পড়তে পারেন। শুধু জাতই বা বলি কেন, সবচেয়ে কাছের লোকটিও মেরে ফেলতে পারে। ভিন্ন সম্প্রদায়ে বিয়ে করার অপরাধে মা মেয়েকে গলা টিপে মেরে ফেলছেন, বাবা গুলি করে মেরে ফেলছেন, ভাই পিটিয়ে মেরে ফেলছেন, আবার তার নাম দেওয়া হচ্ছে ‘অনার কিলিং’। আমরা নিশ্চয়ই হরিয়ানার মনোজ বানওয়ালা ও বাবলি, বিহারের ইমরানা, ঝাড়খণ্ডের নিরুপমা পাঠক, তুরস্কের আহমেদ ইলদিস, লন্ডনের কুর্দি কন্যা হেসু ইয়েনসের কথা ভুলে যাইনি। পৃথিবীজুড়েই অনার কিলিংয়ের সংখ্যা বাড়ছে। শুধু যে ভিন্ন জাতি-ধর্মে বিয়ের কারণে অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটছে, তা নয়। স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ চাইতে গিয়ে, এমনকি সমাজের চোখে অপছন্দনীয় পোশাক পরিধান করেও অনার কিলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে। যে আচরণ, যে সিদ্ধান্ত পরিবার, জাতি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের পছন্দ হবে না তার বিপরীত কিছু করলে সমাজ, পঞ্চায়েত, কখনো পরিবার নিজেই রায় দিয়ে দিচ্ছে হত্যার। পরিবারেও ভিন্নমতের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কী অদ্ভুত! মানুষ দাবি করছে সে এগিয়েছে অথচ তার মতো নয় যারা; সেটি হতে পারে চেহারায়, বর্ণে, চিন্তায়, মতে তাকেই মেরে ফেলছে। অথচ ভিন্নমত কোথায় নেই?

ধর্ষণ শব্দটি নিয়েও ভিন্নমত রয়েছে। কেউ ভাবেন ধর্ষণ এমন এক শব্দ, যা এর শিকার মানুষটিকে অবসাদগ্রস্ত করে ফেলে। কাজেই ধর্ষণ শব্দটির পরিবর্তে অন্য শব্দ ব্যবহার করা উচিত। অন্য পক্ষ ভাবতে পারে ধর্ষণ নিজেই তো ট্রমা। ট্রমার ধারণায় ট্রমাটিক শব্দই ব্যবহার করতে হবে। ধর্ষণ শব্দটি দিয়ে আপনি মনের ওপর যে চাপ তৈরি করতে পারেন, নির্যাতন বললে তত দূর চাপ তৈরি হয় না। কানকে আরাম দেওয়ার জন্য তো ধর্ষণ শব্দটি উচ্চারণ করা হয় না। কোনো কিছুতেই আমরা সিরিয়াস নই। ইভ টিজিংকে নির্দোষ তারুণ্যের ছিটাফোঁটা বখাটেপনা বলে আমরা উড়িয়ে দিই। ভাবি, মুষ্টিমেয় ছেলেপেলের কাজ। ভাবি, ইভ টিজিং বোধ হয় হতাশাগ্রস্ত, অকৃতকার্যদের সাময়িক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার কিক। এভাবে ছোট অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে দিতে বড় অন্যায়, এমনকি ধর্ষণের মতো অন্যায়কে পর্যন্ত আমরা আমাদের অজান্তেই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ফেলি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

Print Friendly, PDF & Email

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




© All rights reserved © 2019 pirojpursomoy.com
Design By Rana
error: Content is protected !!