শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:২৬ অপরাহ্ন
কিশোরগঞ্জের ইটনায় বাবার বাড়িতে স্বামীর পাশে ঘুমন্ত অবস্থায় আকলিমা আক্তার (২০) নামে এক গৃহবধূকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে খুন হওয়ার রহস্যের জট খুলেছে।
পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে ঘটনার আদ্যোপান্ত। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর আঁততায়ী বড় ভাই মোতাহার (৩০) বোন হত্যার নৃশংস বর্ণনা দিয়েছে। প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে আদরের ছোটবোনকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে সে হত্যা করে। এজন্যে বোন ও ভগ্নিপতিকে পানিতে মিশিয়ে কৌশলে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুমাতে পাঠায়। এর আগে সে ঘরে বোন-ভগ্নিপতির খাট বরাবর বাইরে থেকে শাবল দিয়ে সিঁধ কাটে, যেন মনে হয় সিঁধ কেটে ঘাতক ঘরে ঢুকে বোনকে হত্যা করেছে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব বর্ণনা দিয়েছে ভগ্নিহন্তারক মোতাহার। বুধবার দুপুরে কিশোরগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. রফিকুল বারী তাঁর খাসকামরায় ঘাতক মোতাহারের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন। ইটনা থানার ওসি মোহাম্মদ মুর্শেদ জামান বিপিএম এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইটনা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আহসান হাবীব আদালতে মোতাহারের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ঘাতক মোতাহার ইটনা উপজেলার রায়টুটী ইউনিয়নের কানলা গ্রামের মৃত ইছহাক আলীর ছেলে।
মোতাহারের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে ইটনা থানার ওসি মোহাম্মদ মুর্শেদ জামান বিপিএম জানান, নিহত আকলিমা আক্তারকে একই গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে মাসুক মিয়া বিয়ে করতে চেয়েছিল। মাসুক মিয়া আকলিমা আক্তারকে বিয়ের প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু আকলিমার পরিবার এই বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এতে মাসুক ক্ষিপ্ত হয়ে জোরপূর্বক আকলিমাকে বিয়ের হুমকি দেয়। এ পরিস্থিতিতে উপায় না দেখে বছর খানেক আগে তাড়াইল উপজেলার বরুহা বড়হাটি গ্রামে ফুফাতো ভাই জিন্নত আলীর সঙ্গে আকলিমাকে বিয়ে দেয় তার পরিবার। এর জের ধরে গত বৈশাখ মাসে ধান কাটা অবস্থায় মাসুক মিয়া তার লোকজন নিয়ে আকলিমার পরিবারের সদস্যদের উপর হামলা চালায় এবং আকলিমার ভগ্নিপতি বকুলকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে বাম পা ভেঙ্গে পঙ্গু করে দেয়। হামলাকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতেও ভয় পায় আকলিমার পরিবার। এ ঘটনার পর আকলিমার বড় ভাই মোতাহার ঢাকায় রিক্সা চালানোর জন্য চলে যায়। গত কোরবানীর ঈদের আগে সে মাসুক মিয়াকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করে। এজন্যে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসার সময় সে ঘুমের ওষুধ সাথে নিয়ে আসে। ঈদের পর মোতাহার ছোট বোন আকলিমার বাড়িতে যায় এবং বোন জামাই জিন্নত আলীকে তাদের বাড়িতে আসার জন্য দাওয়াত করে। গত ১৪ই আগস্ট বিকালে আকলিমা ও তার স্বামী জিন্নত আলী কানলা গ্রামে মোতাহারদের বাড়িতে আসে। পরদিন ১৫ই আগস্ট রাত ৯টার দিকে মোতাহার কৌশলে একটি জগে পানির মধ্যে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে আকলিমা এবং জিন্নত আলীকে সাথে নিয়ে রাতের খাবার খেতে বসে। সে কৌশলে আকলিমা এবং জিন্নতকে ঘুমের ঔষধ মেশানো জগের পানি খাওয়য় এবং রাত ১০টার দিকে বসতঘরের মাঝখানের কক্ষে লোহার খাটের ওপর তাদের ঘুমাতে দেয়। রাত ১১টার দিকে মোতাহার ঘরে থাকা একটি শাবল নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আকলিমা এবং জিন্নত যে খাটের উপর ঘুমিয়েছিল সে খাটের নিচে বাইরে দিয়ে সিঁধ কেটে আবার ঘরে চলে যায়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে মোতাহার ঘরে থাকা চাকু দিয়ে সজোরে আকলিমার বুকের বাম পাশে পর পর দুইটি আঘাত করে। এ সময় আকলিমা আর্তচিৎকার করে ওঠলে চাকুটি বিছানার উপর ফেলে দ্রুত ঘর থেকে বাইরে চলে যায় মোতাহার। এ সময় ঘরের ভেতর থাকা সবাই ঘুম থেকে জেগে ওঠে আকলিমাকে বাঁচানোর জন্য ঘর থেকে ধরাধরি করে বারান্দায় নিয়ে আসে। এ সময় মোতাহারও ঘরের ভেতর ঢুকে বোনকে ধরাধরি কওে এবং বারান্দায় আনার পর আকলিমার মাথায় পানি ঢালে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই আকলিমা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
এদিকে মোতাহার এ রকম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়ে এর দায় প্রতিপক্ষ মাসুক মিয়ার উপর চাপানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশের কুশলী তদন্তে বেরিয়ে আসে প্রকৃত ঘটনা। গত রোববার (১৬ই আগস্ট) দুপুরে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের পাঠানোর সময়েই পুলিশ নজরবন্দি করে ভাই মোতাহারকে। সোমবার ময়নাতদন্ত শেষে লাশ দাফনের পর পরদিন মঙ্গলবার দুপুরে নিহত আকলিমা আক্তারের মা আরজুদা বেগম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে ইটনা থানায় মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় মোতাহারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে পুলিশ। আটকের পর পুলিশের জেরার মুখে পড়ে সত্য প্রকাশ করে মোতাহার। জানায়, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেই সে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ছক কষেছিল। পরে বুধবার দুপুরে মোতাহারকে কিশোরগঞ্জের আদালতে পাঠানোর পর হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিয়ে সে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।