শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:১২ অপরাহ্ন
৯ মাস আগে দিরাই উপজেলার পেরুয়া গ্রামের বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা গীতা রায়ের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ যাছাই-বাছাই প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য চিঠি দিয়েছিল জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। মন্ত্রণালয় দ্রুততম সময়ে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশনা দিলেও স্থানীয় প্রশাসন করোনার অজুহাতে এখনো প্রতিবেদন তৈরি করেনি। যার ফলে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা জামুকা। মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজের আত্নত্যাগের স্বীকৃতি দেখার অপেক্ষায় ছিলেন গীতা রায়। কিন্তু সেই স্বীকৃতি দেখে যেতে পারেননি তিনি। গত ১৯ অক্টোবর বিনা চিকিৎসায় নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেছেন বীরঙ্গনা গীতা রায়। জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধে তার অসামান্য অবদান ও আত্নত্যাগের সরকারি স্বীকৃতির দেখা না পেয়েই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছে তাকে। গীতা রায়ের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেন পেরুয়া গ্রামের একাত্তরের নির্যাতিত নারী গীতা রায়। একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর এলাকার কুখ্যাত দালাল আব্দুল খালেকের সশস্ত্র রাজাকারদলের নৃশংসতার শিকার হন হয় গীতা রায়ের পরিবার। তার উপর চালানো সীমাহীন বর্বরতার কারণে অন্যদের মতো তিনিও ভয়ে আজীবন চুপসে ছিলেন। কারণ দালাল আব্দুল খালেকের লোকজন এখনো এলাকার রাজনীতিতে সর্বেসর্বা। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারো নেই। তাই অন্যদের মতো পরিবারের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে একাত্তরের চিরন্তন দহন নিজেই বহন করছিলেন। দালাল ও তাদের স্বজনদের আস্ফালন মুখ বুঝে সহ্য করছিলেন। ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর খালেক দালালের ছেলে জোবায়ের মনিরসহ জাকির হোসেন, তোতা মিয়া টেইলার, সিদ্দিকুর রহমান, আব্দুল জলিল, আব্দুর রশিদসহ অভিযুক্ত ছয় যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করে পুলিশ। এই ঘটনায় বুকে সাহস সঞ্চয় করে বীরাঙ্গনা স্বীকৃতির আবেদন করেন গীতা রায়। তার মতো সাহসী হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে কথা বলতে শুরু করেন একাত্তরের শহীদ পরিবারের লোকজন। গীতা রায়ের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা গেছে, তার স্বামী ছিলেন পেরুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধের একজন নিভৃতচারী সংগঠকও ছিলেন তিনি। এ কারণে তার প্রতি ক্ষুব্দ ছিল স্থানীয় রাজাকাররা। একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর পার্শবর্তী দৌলতপুর গ্রামের দালাল আব্দুল খালেক, মুকিত মনির, ডা. আব্দুস সোবান, এলিম উদ্দিন, তোতা টেইলার, জোনায়েদ মনির, জুবায়ের মনির প্রদীপ, সোনা মিয়াসহ এলাকার কয়েক শতাধিক প্রশিক্ষিত রাজাকার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পেরুয়াসহ আশপাশের গ্রামে প্রবেশ করে। গ্রামে ডুকে নির্বিচারে নারীনির্যাতন, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। এসময় তারা পেরুয়া গ্রামের ২৭ জনকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। গীতা রায়ের স্বামী স্কুল শিক্ষক উপেন্দ্র রায়কেও ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। গীতা রায়কেও শিশু সন্তানদের সামনে নির্যাতন করে। পরে তাকে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েও নির্যাতন চালায়। রাজাকাররা গীতা রায় ও তার স্বামীকে নির্যাতন করে যাবার সময় এক পুত্র ও তিন মেয়েসহ চার শিশু সন্তানকে বের করে ঘরে আগুন দিয়ে যায়। শিশু সন্তানদের কথা বলে রাজাকারদের হাত পা ধরে বাড়িতে ফিরে আসেন গীতা রায়। এর মধ্যেই স্বাধীন হয়ে যায় দেশ। পঁচাত্তরের পর আবার বিজয়ের বেশে এলাকায় ফিরে দালাল রাজাকাররা। একাত্তরের নির্মমতার কথা স্মরণ করে গীতা রায় চুপসে যান। শুরু হয় তার নতুন জীবন সংগ্রাম। বাবার পরিবারের লোকজনের সহায়তায় স্বাধীন দেশে পোড়া ভিটায় তার স্মৃতি নিয়ে বাঁচতে খুপড়ি ঘর করে বসবাস করেন। অনেক কষ্টে একমাত্র ছেলে ও তিন মেয়েসহ চার শিশু সন্তানকে বড় করেন। স্বামীর যে অল্প জমিজমা ছিল তা বিক্রে করে বিয়ে দেন মেয়েদের। শেষ জীবনে নিঃস্ব অবস্থায় একমাত্র ছেলে দিনমজুর দীপক রায়ের সঙ্গেই বসবাস করতেন গীতা। গত ১৯ অক্টোবর হঠাৎ তার সারা শরীর ফুলে যায়। সাধ্য না থাকায় হতদরিদ্র পুত্র চিকিৎসাও করাতে পারেননি। তাই বিনা চিকিৎসায় নীরবেই মারা যান একাত্তরের বীরাঙ্গনা গীতা রায়। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে স্বীকৃতির আবেদনের পর মহিলা মুক্তিযোদ্ধা (বীরাঙ্গনা) বিশেষ কমিটি কর্তৃক যাছাই-বাছাই পূর্বক প্রতিবেদনের জন্য গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দিরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে ৪৮.০২.০০০০.০০৩.২২.০০১.১৯৭৭ নং স্মারকে পত্র দেয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। জামুকার সহকারি পরিচালক মো. আব্দুল খালেক স্বাক্ষরিত পত্রে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালককেও অনুলিপি প্রদান করা হয়। এই স্মারকের পত্রটি দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে পৌঁছলে দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে গত ১৯ মার্চ ০৫.৪৬.৯০২৯.০০০.০৭.০০৪.২০.৩৮১ নং স্মারকে উপজেলা যাছাই বাছাই কমিটিকে প্রতিবেদন প্রদানে পত্র দেন। যাছাই-বাছাই নীতিমালা মেনে ৫ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশনা দিলেও ইতোমধ্যে প্রায় ৮ মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। যাছাই-বাছাই কমিটির সদস্য সহকারি কমিশনার (ভূমি) ফারিয়া সুলতানা, মেডিক্যাল অফিসার ডা. মনি রাণী তালুকদার, ব্রাকের উপজেলা সমন্বয়কারী পারুল আক্তার, দিরাইয়ের তথ্যসেবা কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস ও উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এখনো যাছাই বাছাই করেননি। করোনার অজুহাতে এখনো যাছাই-বাছাই করতে পারেনি কমিটি। এর মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন বীরাঙ্গনা গীতা রায়। এদিকে গীতা রায়ের আবেদনের বিষয়টি কোন পর্যায়ে আছে জানার জন্য কিছুদিন আগে জামুকায় খোজ নেন স্বজনরা। তখন জামকুা থেকে জানানো হয় যাছাই-বাছাইয়ের জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু এখনো যাছাই-বাছাইয়ের প্রতিবেদন না পাওয়ায় তারা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। গীতা রায়ের পুত্রবধু সঞ্চিতা রায় বলেন, আমার শাশুড়ি একাত্তরে আমার শ্বশুর ও তার উপর নির্যাতনের ঘটনায় স্তব্দ হয়ে গিয়েছিলেন। সেই বিভৎসতা ভুলতে পারেননি তিনি। প্রসঙ্গ উঠলেই শুধু কাঁপতেন। গত বছর তিনি কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলেন। আবেদনের পর অপেক্ষায় ছিলেন কবে তিনি স্বীকৃতি পাবেন। কিন্তু স্বীকৃতি পাবার আগেই তিনি মারা গেছেন। গীতা রায়ের মেয়ে দেবী রায় বলেন, সংগ্রামের ৬ বছর আগে আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল। সংগ্রামের আগেই আমাদের ১ ভাই ও তিন বোনের জন্ম হয়। আমার ভাইয়ের বয়স ছিল চার বছর। পরে আমরা তিন বোন জন্ম নেই। আমার ছোট বোনের বয়স ছিল ৩ মাস। এই সময় আমাদের বাড়িতে এসে বাবাকে ধরে নিয়ে হত্যা করে রাজাকাররা। মাকেও নির্যাতন করে। আমরা চার ছোট ভাই-বোনদের দোহাই দিয়ে মা কোন মতে রাজাকারদের কবল থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। আমার মা মুক্তিযোদ্ধার আফসোস নিয়েই চলে গেলেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অমরচান দাশ বলেন, পেরুয়া গ্রামসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে ৪ ডিসেম্বর গণহত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালিয়েছিল প্রশিক্ষিত রাজাকাররা। ওইদিন গীতা রায়ের স্বামীকে হত্যা করে তার বসতবাড়ি লুটপাট শেষে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তার স্ত্রীকেও নির্যাতন করা হয়। ২০১৩ সনের গণজাগরণ মঞ্চের পর এলাকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন একাত্তরের নির্যাতনের কথা বলতে শুরু করেন। কিছু মানুষ সাহস করে মামলা দায়ের করেন। সম্প্রতি কয়েকজন প্রভাবশালী যুদ্ধাপরাধী মামলায় জেলে গেলে গীতা রায় তার উপর চালানো বর্বরতার বিষয়টি তুলে ধরে সরকারের কাছে স্বীকৃতির আবেদন করেন। তার আবেদনটি আমলে নিয়ে জামুকা স্থানীয় প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছিল ৯ মাস আগে। এতদিনে তিনি স্বীকৃতি পেয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু বিলম্বের কারণে আটকে আছে। আশা করি সংশ্লিষ্টরা প্রতিবেদনটি শিগগিরই জামুকায় পাঠাবেন। দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফিউল্লাহ বলেন, জামুকা থেকে পত্রটি আসার পরই আমি যাছাই-বাছাইয়ের জন্য উপজেলা কমিটিতে পত্র দিয়েছিলাম। তারা করোনার কারণে যাছাই-বাছাই সম্পন্ন করতে পারেননি। তবে শিগগিরই যাছাই-প্রতিবেদন জামুকায় পাঠানো হবে।