শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:৪২ অপরাহ্ন
জহির সিকদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেঃ
পাকা ক্যানেল, সাইফোন গুঁড়িয়ে দিচ্ছে হেভী শক্তিশালী যন্ত্র দ্বরা। বালুতে চাপা পড়ে নিশ্চিন্ন হয়ে যাচ্ছে তা। মহাসড়ক প্রশস্তকরণের কারনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৩৪ হাজার কৃষকের স্বপ্ন এভাবেই ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। ৪৫ বছর আগে যে প্রকল্প এলাকার কৃষকের জন্য খুলে দিয়েছিল অমিত সম্ভাবনার দুয়ার, পতিত পড়ে থাকা জমিতে সবুজের জাল ছড়িয়ে দিয়েছিল। যার ওপর ভিত্তি করে ইরি চাষের সূচনা হয়েছিল এত্র এলাকায়। দেশে ব্যতিক্রমী সেই সবুজ প্রকল্পটি এখন বন্ধের পথে। আসছে বোরো মৌসুমে ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা মিলবে কিনা তা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে সড়ক প্রশস্তকরণের কারনে।
আশুগঞ্জ নদীবন্দর,সরাইল-ধরখার-আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ককে চারলেন জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজের জন্য ইতিমধ্যেই ঔ প্রকল্পের বিভিন্ন অংশের ক্যানেল ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এর আগে গত বছর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড স্থাপনা নির্মাণ করবে বলে প্রকল্পের কুলিং রিজার্ভার হিসেবে ব্যবহ্নত আশুগঞ্জের পিডিবির সন্নিকটের একটি পুকুর ভরাট করে ফেলেছিলেন। পরবর্তীতে মহাসড়কের এই কাজের জন্য কৃষি ও কৃষকের স্বপ্নের এই প্রকল্প এখন পুরোপুরি বন্ধের জোগাড় হয়েছে।
বিএডিসি সূত্র জানায়, প্রকল্পটি সচল রাখার উপায় বের করতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা উইং) মো. জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে সড়ক এলাইনমেন্ট, সংশোধিত প্রস্তাবিত ডিজাইন, ভূমির পরিমাণ, ঢাকা-সিলেট প্রকল্পের আদলে বিদ্যমান ডিজাইন পর্যালোচনা, বিএডিসি’র ইরিগেশন চ্যানেল প্রতিস্থাপন-বিকল্প ব্যবস্থা সরেজমিনে পরিদর্শনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। গত ১০ই অক্টোবর কমিটির সদস্যরা সরেজমিনে তা পরিদর্শন ও করে গেছেন । এরপর একটি সভায় মিলিত হয়ে ২৯শে অক্টোবর তারা কিছু সুপারিশ পেশ করেন। এসব সুপারিশে সওজের বর্ণিত সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের ঢাকা-সিলেট জাতীয় মহাসড়ক অংশের (চেইনেজ ৭৩+২৪০ কিলোমিটার থেকে ৮৪+৮০০ কিলোমিটার) নকশা পরিবর্তন করে প্রস্তাবিত ঢাকা-সিলেট জাতীয় মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের (এন-২) নকশার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সড়ক সম্প্রসারণ করতে বলা হয়। এরপর সড়কের যে সকল অংশে ইরিগেশন চ্যানেল নির্মাণের জন্য সওজ-এর অধিগ্রহণকৃত ভূমিতে বিএডিসিকে জায়গা দেয়া সম্ভব এবং যে অংশে ইরিগেশন চ্যানেল নির্মাণের প্রয়োজনে বাড়তি ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে সেটি সওজকে নিরূপণ করতে বলা হয়। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিএডিসি প্রস্তাবিত ক্যানেলের প্রশস্ততা ৮ মিটারের পরিবর্তে ৪ মিটার করার সুপারিশ করে এ কমিটি। এ প্রশস্ততায় আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের পানি প্রবাহের মূল পয়েন্টের উচ্চতা এবং পানির গতি বৃদ্ধি এবং ক্যানেলের উচ্চতা ২ মিটারের বেশি বাড়ানো হলে পানি প্রবাহ কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব বলে তারা মতামত ব্যক্ত করেন। তবে সুবিধা পেতে ক্যানেলের প্রশস্ততা ৬ মিটার করার বিষয়ে মত দেন কমিটির সদস্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি। কমিটি এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনে জরুরী আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা করে বিষয়টি সুরাহার সুপারিশ করেন। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের ওই সভা এখনো হয়নি। এরই মধ্যে গত জুলাই মাস থেকে পুরোদমে শুরু হয়েছে সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ। আশুগঞ্জ থেকে বিশ্বরোড পর্যন্ত বিএডিসির ক্যানেল অংশে বালি ভরাট কাজ চলছে তোড়জোড়ে। বিএডিসি’র কর্মকর্তারা বলেন, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই বোরো চাষের জন্যে তারা সেচ সুবিধে চালু করতেন। কিন্তু তা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়লো। জানা যায়, ১৯৭৫ সালে কৃষি ক্ষেত্রে বিশেষ এই প্রকল্পটি চালু হয়। কাগজে নাম আশুগঞ্জ-পলাশ এগ্রো ইরিগেশন প্রকল্প হলেও সবুজ প্রকল্প হিসেবেই অধিক পরিচিত এটি। আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কুলিং সিস্টেমে ব্যবহারের জন্যে মেঘনা নদী থেকে উত্তোলিত পানি ব্যবহারের পর তা পুনরায় আবার নদীতে ফেলে দেয়া হতো। ১৯৭৫ সালে এলাকার সমাজসেবী মাহবুবুল হুদা ভূঁইয়া ও খোরশেদ সিকদার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের বর্জ্য পানিকে জমিতে সেচের কাজে ব্যবহারের উদ্যোগ নেন। আর এতে এলাকার জমিতে ইরি চাষে সাফল্য এলে সরকার ১৯৭৮-৭৯ সালে বিএডিসি’র মাধ্যমে এই সেচ সুবিধাকে আরো সম্প্রসারণ করেন। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহারের পর ফেলে দেয়া পানিকে নির্দিষ্ট একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য বিভিন্ন সেচ অবকাঠামো নির্মাণ করা ছাড়াও বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত গরম পানি সরাসরি জমিতে না দিয়ে কুলিং রিজার্ভারে রেখে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। প্রকল্পের শুরু থেকে আশুগঞ্জ সদরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একটি পুকুরকে কুলিং রিজার্ভার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই গত বছরের জুন মাসে পুকুরটি ভরাট করে ফেলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। তখন থেকেই প্রকল্পটি হুমকির মুখে পড়ে। আশুগঞ্জ উপজেলা ছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, সরাইল ও নবীনগরের ৩৪ হাজারেরও বেশি কৃষক এই প্রকল্পের সুবিধাভোগী। এসব উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের ১৬ হাজার হেক্টর জমি চাষ হয় এই সেচ সুবিধাতে। প্রকল্পের প্রধান সেচ খাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল আশুগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশের বরোপিট ক্যানেলকে। মহাসড়ক প্রশস্তকরণ কাজের জন্য এই ক্যানেল ভরাট করে ফেলা হচ্ছে এখন। এমতাবস্থায় উক্ত প্রকল্পটি পুরোপুরি ভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার কৃষক। এই সেচ সুবিধাতে এলাকার ফসল চাষে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছিল বলে জানান এলাকার কৃষকরা। ইরি ফসলের আবাদ শুরু হয় এই পানির ওপর নির্ভর করেই। বর্তমানে এই সেচ সুবিধে কাজে লাগিয়ে বছরে ৫৬ হাজার ২৫০ টন ইরি ধান উৎপন্ন হচ্ছে। গ্রাভিটি ও লিফটিং পদ্ধতিতে প্রতি একরে ৪শ’ ও ২শ’ টাকা সেচকর দিয়ে সেচ সুবিধা পাচ্ছেন কৃষকরা। প্রকল্পটি বন্ধ হলে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা কৃষকদের। সরাইল উপজেলা চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন ঠাকুর বলেন, জমিতে পানি না পেলে এলাকার লাখো মানুষ ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করবে। দাবি আদায়ের জন্যে যা যা করার আমরা তাই করবো। বিএডিসি’র কর্মকর্তারা জানান, এটি সারা দেশের একটি ইউনিক প্রকল্প এবং পরিবেশবান্ধব। এতে ভূগর্ভস্থ পানি লিফটিং করতে হচ্ছে না। বরং উপুর্যপুরি আমাদের গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ হচ্ছে। তবে প্রকল্পের এই হাল নিয়ে মুখ খুলতে রাজি নন তারা।